শিশু ধর্ষণের বিচারের দাবিতে রাজপথে মা
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৪-০১-২০২৫ ০১:৫৩:০৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৪-০১-২০২৫ ০১:৫৩:০৩ অপরাহ্ন
সংবাদচিত্র : সংগৃহীত
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিদিনই অনেক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। লাউড স্পিকারে বক্তব্য দিয়ে, ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে জানানো হয় দাবি-দাওয়ার কথা। এসবের ভিড়ে গত কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ছে এক নারীকে। দুই শিশুকে সঙ্গে নিয়ে পাটি বিছিয়ে ফুটপাতেই বসে থাকছেন তিনি। উপরে সাঁটিয়েছেন ব্যানার। যেখানে লেখা ‘আমরণ অনশন’। আর দাবি বিষয়ে লেখা ‘সাত বছরের মেয়ের ধর্ষণকারীর ফাঁসি চাই’, তার একটু নিচেই লাল হরফে বড় করে লেখা, ‘বিচার চাই’।
ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, তিনি এসেছেন গাজীপুর থেকে। তাঁর দাবি, তার ৭ বছরের মেয়ে শিশু পাশের বাসার এক ভাড়াটিয়ার কক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার তিনি বিচার পাননি। এমনকি থানায় তাঁকে পুলিশ হেফাজতে রেখে ধর্ষণের আলামত হালকার করারও চেষ্টা হয়েছে। বিষয়টি মিটমাটের জন্য মোটা অংকের টাকাও দিতে চাওয়া হয়েছিল। পরে তাকে রাজি করাতে না পেরে মামলা নেওয়া হয়েছে। তবে সেই মামলার চার্জশিটেও ধর্ষণের ঘটনাকে দুর্বল করে ‘ধর্ষণ চেষ্টা’ উল্লেখ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এই নারী। যদিও তদন্তকারী কর্মকর্তা বলছেন, থানা হেফাজতে আটকে রাখার ঘটনা তার জানা নেই। আর চার্জশিট নিয়ে ওই নারীর অভিযোগ ঠিক নয়, তিনি যা পেয়েছেন সেভাবেই প্রতিবেদন দিয়েছেন।
শিশুটির মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তার মেয়ে এমন পৈশাচিক ঘটনার শিকার হয়েছে।
ছোটবেলায় বাবা হারানো ভুক্তভোগী ওই শিশু স্থানীয় একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ১৩ জুলাই মেয়ে এবং ছোট ছেলেকে বাসায় রেখে ভবানীপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান তিনি। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে মেয়েকে ডাকাডাকি করলে দরজা খুলতে দেরি করে সে। পরে শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই দরজা খোলে শিশুটি। অসুস্থার কারণ জিজ্ঞাস করলে সে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, পাশের ভাড়াটিয়ার রুমে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম (৪০) তাকে ধর্ষণ করেছে।
ওই ভাড়াটিয়ার বাসায় অভিযুক্ত শফিকুল ইসলামের আগে থেকেই যাতায়াত ছিল বলেও জানান ভুক্তভোগী শিশুটির মা। তিনি বলেন, ‘আমি যেখানে ভাড়া নেই, তার পাশের ভাড়াটিয়ার রুমে শফিকুল ইসলাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নারীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। সেখান থেকেই সে আমার মেয়েকে দেখতো। এর আগে তার এক সহযোগীও আমার মেয়েকে হয়রানি করার চেষ্টা করে। সেটি নিয়ে স্থানীয়ভাবে বিচার-সালিশ হয়। তখন এই শফিকুলের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। আমার ধারণা, তার পর থেকেই আমার ওপর সে ক্ষুব্ধ ছিল। আর এ কারণেই সে আমার মেয়ের ওপর এমন নির্যাতন চালিয়েছে।’
ঘটনার দিনই থানায় গেলেও পুলিশ অভিযোগ আমলে নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন এই নারী। থানার অভিযোগপত্রের একটি কপি দেখান তিনি। সেখানে দেখা যায়, ঘটনার তিন দিনের মাথায় ১৫ জুলাই অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়েছে। বিলম্বের কারণ হিসেবে দেখানো হয়, ওই নারী তার মেয়ের ঘটনা নিয়ে আশপাশের সবার সঙ্গে আলোচনা করে থানায় আসতে দেরি হয়।
থানার ঘটনার বিবরণ দিয়ে শিশুটির মা বলেন, ‘ওইদিন রাতেই থানায় গেলে তৎকালীন ওসি আকবর বলেন— তুমি হাসপাতালে না গিয়ে ভালো করেছো। সেখানে তোমার নিরাপত্তা কে দিতো? এখানে পুলিশ হেফাজতে থাকবা।’
পরে থানায় বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করা হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আসামিরপক্ষের লোকেরা স্থানীয় প্রভাবশালী। তারা বিভিন্ন জনের মাধ্যেমে বলায় যে— মামলা করে কী করবা? ছোট বাচ্চা, তুমি গরিব মানুষ; তোমার সম্মানটাই বড়। যা কিছু হইছে না হইছে, এটা যেহেতু জানা জানি হয় নাই; তোমাকে টাকা-পয়সা নিয়ে দেই, মেয়েটাকে চিকিৎসা করায়া এখান থেকে দূরে কোথাও গিয়ে সুন্দরভাবে বাইচা থাকো গা।’
ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা প্রস্তাব দেওয়া হয় জানিয়ে ভুক্তভোগীর শিশুটির মা বলেন, ‘ওসি আকবর আসামির পরিবারকে নিয়ে আমাকে ৫ লাখ টাকার প্রস্তাব দিলো। টাকার বান্ডিল ওসি সাহেবের অফিসে রাখছে। পরে ওসি আমাকে বলে— তোমার যদি আরও চাওয়ার থাকে আমাকে বলতে পারো, আমি আদায় করে দেওয়ার চেষ্টা করবো। ওদের টাকাপয়সা আছে, আদালতে গিয়ে বের হয়ে আসবে। তখন আমিও তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না।’
এমন প্রস্তাবে রাজি না হলে তাকে থানা হেফাজতে রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘টাকা না নিয়া আমি ওসির হাত-পা ধরেও বলেছি— স্যার, মেয়েটাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে দেন, তার রক্ত ঝরছে, সে অসুস্থ। ব্যাথায় কাতড়াইতাছে, মেয়েটা জ্বরে আসছে। কিন্তু দিলো না। ওসি শুধু বলছে— চিন্তা-ভাবনা করো, আর মেয়েটাকে সুস্থ করো। আমি মেয়েটার থানায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। পরে ওসি সাহেব কিছু ভালো ভালো খাবার, ওষুধ-বড়ির ব্যবস্থা কইরা থানায় রাখছে। যখন আমারে রাজি করাইতে পারে নাই, পরে ১৫ তারিখ ধর্ষণের মামলা হয়। মামলা হলে ফরেনসিকের জন্য মেয়েকে হাসপাতালে পাঠায়। ফরেনসিক করার পরে আরও একদিন থানায় রাখা হয়।’
ধর্ষণের সব প্রমাণ নেওয়ার পরও মামলার চার্জশিটে ‘ধর্ষণচেষ্টা’ উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে ভুক্তভোগী শিশুটির মা বলেন, মামলা হওয়ার পর আমার মেয়ের রক্তাক্ত করার কাপড়-চোপড় দারোগা শনাক্ত কইরা প্যাকেটে নিছে, বিছানার চাদরও নিছে। সিসি টিভির ফুটেজ ছিল ঘরের বাইরের। ওই ফুটেজে আমার দুইডা বাচ্চার চিৎকার চেঁচামেচি কান্নার ভিডিও আছে। ওই আসামি যে দৌড় দিয়ে বাইর হইয়া গেছে, সেই ফুটেজও আছে। ঘরে ঢুকছে; সব কিছুর প্রমাণ ছিল। এগুলা সব পুলিশ নিছে। এখন দেখেন, চার্জশিটে বলা হইছে, আমার মেয়েকে নাকি ধর্ষণের চেষ্টা করা হইছে। আমার মেয়ের নাকি কোথাও কোনও ক্ষত নাই, আমার মেয়ের নাকি কোনও রক্তাক্ত কাপড়-চোপড় তারা নেয় নাই। অথচ এসআই হেলালের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। সে প্রমাণ নেওয়ার কথা স্বীকারও করছে। সেই ফোন রেকর্ডও আছে আমার কাছে।’
প্রমাণ লুকানো হয়েছে অভিযোগ করে ভুক্তভোগীর মা বলেন, জুলাই-আগস্টে দেশে গন্ডগোল হইলে সিআইডির কাছে আমার মেয়েরে ধর্ষণের প্রমাণের রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগে দারোগার (এসআই হেলাল উদ্দিন) কাছে সব রাইখা ওসি আকবর বদলি হইয়া গেছে। আর সে (এসআই হেলাল) পরে যে ওসি আসছে জয়নাল, তারে সঙ্গে নিয়া সমস্ত প্রমাণ গায়েব কইরা সিআইডিরে কোনও কিছু দেয় নাই। এর জন্য চার্জশিটে কোনও কিছুর উল্লেখ নাই। এখন একটা মিথ্যা চার্জশিট তৈরি করছে।’
এ ঘটনায় অভিযুক্ত শফিকুল ইসলাম গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আটক আছে। তবে যে কোনও সময় জামিনে বের হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে ধর্ষণ না করলে কি এইভাবে আমাকেসহ আমার মেয়েরে চারদিন থানায় রাখছে? আর ধর্ষণ মামলা কি এমনি এমনি করছে? আর স্থানীয় প্রভাবশালী এই বেডারে ধর্ষণ মামলা দিয়ে এমনিই জেলে ঢুকায়া দিছে? এখন আমার মনে হচ্ছে আমি ন্যয়বিচার পাবো না। আসামি জামিন নিয়ে বের হয়ে যাবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার এসআই হেলাল উদ্দিন বলেন, থানায় হেফাজতে রাখার বিষয়টি আমি জানি না। ১৫ জুলাই মামলা দায়ের হয়। মামলা হলে আমি আসামি ধরে আনি। তাকে জেলে পাঠানো হয়।তবে ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে এসআই হেলাল উদ্দিন স্পষ্ট করে কিছু বলেন নাই। তিনি বলেন, ‘আগের ঘটনা, সব মনে নাই। তবে নমুনা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা আদালতে পাঠিয়ে থাকেন। নমুনা আদালত থেকে সিলগালা করে সিআইডিতে পাঠানো হয়। আর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ কেন লাগবে? আসামিকে যে আসতে-যেতে দেখা গেছে, সেখানে ধর্ষণের চেষ্টা করছে বলে মনে হয়েছে, সেটাই চার্জশিটে দিয়েছি।
এবিষয়ে জানতে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রীপুর থানার সাবেক ওসি আকবর আলী খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলা স্কুপ/ প্রতিবেদক/ এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স